Single Page

বিনা বিচারে কারাগারে ফারুকের ৩০ বছর : ৩৭ বছর বয়সে ঢুকে বের হলেন ৬৭ বছরে

যুবক বয়সে কারাগারে গিয়ে বিনাবিচারে দীর্ঘ ৩০ বছর কারাভোগের পর বৃদ্ধ বয়সে মুক্ত হলেন ফারুক হোসেন। কোনো তদ্বিরকারক না থাকায় কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে ৩০ বছরে কোনো আপিল করা হয়নি তার। এমনকি জেল কর্তৃপক্ষও হাইকোর্টে জেল আপিলটুকুও দায়ের করেননি ফারুকের জন্য। এ কারণে জেলকোড অনুসারে প্রায় ৪০ বছর (স্বাভাবিক বছর হিসেবে ৩০ বছর) স্ত্রী-সন্তানদের থেকে অনেক দূরে কারাগারের অন্ধকারেই জীবন কেটেছে ফারুকের।

১৯৮৯ সালের ৬ জুন প্রতিবেশীদের করা একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেফতার হয় সিলেটের বিয়ানীবাজারের ফারুক হোসেন। তখন তার বয়স ছিল ৩৭ বছর। সেই মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড হয় তার। এই দণ্ড ভোগ করা অবস্থায়ই ১৯৯৩ সালে দুটি হত্যা মামলায় তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে ওই হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলেও তারা একে একে হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্ত হয়। শুধু মুক্ত হতে পারেনি ফারুক। হবেনই বা কিভাবে। তার পক্ষে জামিন আবেদনই করা হয়নি। ছিল না আর্থিক সামর্থ্য, কোনো তদ্বিরকারক। জেল কর্তৃপক্ষও করেননি কোনো জেল আপিল।

২০১৬ সালে ওই হত্যা মামলার আসামি আকল আলী হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে বের হলে তার মাধ্যমে ফারুকের বিনা বিচারে কারাভোগের বিষয়টি নজরে আসে মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সন্সের (এলএএইচপি)। পরে এই সংগঠনের সহায়তায়ই চলতি বছরের ২৯ মে কারামুক্তি মেলে ফারুকের। সাজা ভোগ করা হয়ে গেছে মর্মে হাইকোর্ট হত্যা মামলায় খালাস দেন ফারুককে। সম্প্রতি সময়ের আলোর সঙ্গে কথা হয় ৬৭ বছরের ফারুক হোসেনের। তিনি জানান দেশের বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে কিভাবে ৩০ বছর জেলখানায় বন্দি ছিল। ফারুক বলেন, প্রতিবেশীরা আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দিলে সেই মামলায় ১৯৮৯ সালে গ্রেফতার হই। এই মামলায় দেওয়া ১০ বছরের সাজা খাটার সময়ই দুটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই দুই মামলায় ১৯৯৩ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। তখন থেকে সিলেট, কুমিল্লা, কাশিমপুর ১, ২ ও ৪ এবং মানিকগঞ্জ কারাগারে বন্দি ছিলাম। এর মধ্যে আমার সঙ্গে থাকা সব আসামিই হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হলেও আমি পারিনি। আসলে আমি আপিল করতে পারিনি। আমার জন্য আপিল করার মতোও কেউ ছিল না। কারা কর্তৃপক্ষ জেল আপিলও করেননি। তাই ভাগ্যকে মেনে নিয়ে জীবনটা কারাগারেই কাটিয়ে দিলাম। কী যে যন্ত্রণার জীবন ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না। কোনো দিন মুক্তি পাব কল্পনাতেও ছিল না। মাঝে মাঝে ভাবতাম, মরে গেলে তো নিশ্চয়ই লাশটা কারাগার থেকে বের করবে। তখন ঠিকই বাড়ি যাব। তখন আমাকে সবাই দেখলেও আমি কাউকে দেখব না। আমার বুড়ো চেহারা দেখে অনেকেই আমাকে চিনবে না। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ফারুক। এরপর একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে বলেন, সৃষ্টিকর্তা ভাগ্যে কিন্তু তেমনটা লেখেননি। আমি আজ মুক্ত হয়ে কথা বলছি। আমার স্ত্রী, সন্তান আর নাতি-নাতনিদের দেখছি। এ জন্য সৃষ্টিকর্তা আর এলএএইচপির তৌফিকা আপাকে (অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম) ধন্যবাদ। কারণ আপা না থাকলে হয়তো আমার লাশটাই একদিন কারামুক্তি পেত।

ফারুক জানান, তার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে সিহাবের জন্ম ১৯৮১ সালে। আর মেয়ে পান্নার জন্ম ১৯৮৫ সালে। এখন ছেলে আর মেয়ের ঘরে ১০ জন নাতি-নাতনি ফারুকের। তাদের নিয়েই সময় কাটে তার। স্ত্রীও বেঁচে আছেন। এলাকার লোকজন তার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে তাকে আগামীতে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দেবে বলেছে। তিনি বলেন, জেলখানার জীবন আসলে মৃত মানুষের জীবন। তাই এখন নিজেকে জীবিত মনে হয়। বাকি জীবনটা সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চাই।

ফারুক হোসেনের বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পারসন্সের (এলএএইচপি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম বলেন, আকল আলী নামে এক আসামি ২০১৬ সালে হাইকোর্ট থেকে জামিনে বের হন। তার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি ফারুকের বিষয়টি। আকলই জানান, তাদের মামলায় ফারুক নামের একজন বিনা বিচারে ৩০ বছর ধরে কারাগারে আছে। এরপর আমারা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে ২৯ মে ফারুককে হাইকোর্ট থেকে খালাস করাই। তৌফিকা করিম বলেন, ফারুকের বিষয়টি খুবই দুঃজনক। তার কোনো তদ্বিরকারক না থাকায় জেল জীবনের কখনই হাইকোর্টে আপিল করতে পারেননি। তিনি আসলে স্বাভাবিক হিসেবে ৩০ বছর কারাগারে থাকলেও জেলকোড অনুসারে প্রায় ৪০ বছর কারাগারে ছিল। এটা খুবই অমানবিক ঘটনা।

নিজের সংগঠনের বিষয়ে তৌফিকা করিম বলেন, ফারুকের মতো যারা বিনাবিচারে কারাগারে রয়েছে তাদের কারামুক্ত করে একটি সুন্দর জীবন ফিরিয়ে দেওয়াই এলএএইচপির কাজ। বিশেষ করে অসহায় ব্যক্তিদের যাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং অত্যন্ত দরিদ্র তাদের আইনি সহায়তার মাধ্যমে আমরা কারামুক্তির ব্যবস্থা করি। এই কাজে যত টাকা লাগে তা আমাদের সংগঠনই বহন করে।